Pages

Tuesday, October 15, 2013

ইদানিং অনেকেই বলছেন "আমার অন্তর পরিষ্কার"। আল্লাহ আমাদের শয়তানের ধোঁকা থেকে হেফাজাত করুন। আমিন


এই কথা কিন্তু ইদানিং অনেকেই বলছেন "আমার অন্তর পরিষ্কার"। আল্লাহ আমাদের শয়তানের ধোঁকা থেকে হেফাজাত করুন। আমিন

Posted by QuranerAlo.com - কুর'আনের আলো on Friday, July 3, 2015

Monday, October 14, 2013

নামাজ সারা বছরের জন্য


নামাজ সারা বছরের জন্য

 -মোহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ বিন রেজা

মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা কর আর মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।’                    -সূরা রুম- ৩১
নবীজি বলেন, ‘মুমিন, কাফির ও মুশরিকের মধ্যে পার্থক্য হল, সালাত।’                   -মুসলিম, হা-১৩৪, মিশকাত, হা- ৫৬৯
সাহাবীরাও নামাজ পরিত্যাগকারীদের মুসলিম সমাজের মধ্যে গণ্য করতেন না। ইসলাম কবুল করা আর না করার মানদন্ড হল, নামাজ। রাসূল (সা.) সময়ে মুনাফিকরাও মুসলিম হিসেবে প্রমাণের জন্য নামাযের জামাআতে আসতো। ইচ্ছাকৃত নামাজ ত্যাগকারী বা নামাজ ফরয এটা অস্বীকারকারী কাফির ও জাহান্নামী। এ ব্যক্তি ইসলাম হতে বহিষ্কৃত। কিন্তু যে নামাযের ব্যাপারে ঈমান রাখে অথচ অলসতা ও ব্যস্ততার কারণে নামাজ ত্যাগ করে বা উদাসীনভাবে আদায় করে ও তার প্রকৃত হিফাযত করে না তার বিধান হল, ধ্বংসশীল ব্যক্তি। মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘ধ্বংস ঐসব নামাজীদের যারা নামাযে উদাসীন, যারা তা লোকদের দেখায়।’
-সূরা মাউন, ৪-৬
মুনাফিক, প্রতারক ও ফাসিকঃ মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা প্রতারণা করে আল্লাহ্র সাথে, অথচ তিনি তাদেরকেই ধোঁকায় নিক্ষেপ করেন। যখন তারা নামাযে দাঁড়ায় তখন অলসভাবে দাঁড়ায় লোক দেখানোর জন্য। আর তারা আল্লাহ্কে অল্পই স্মরণ করে।’                                -সূরা নিসা, ১৪২
‘আপনি বলুন, তোমরা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অর্থ ব্যয় কর তা কবুল করা হবে না। তোমরা তো ফাসিকের দল। তাদের অর্থ ব্যয় কবুল না হওয়ার কারণ হল, তারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি অবিশ্বাসী, তারা নামাযে আসে অলসতার সাথে ও ব্যয় করে সংকুচিত মনে।’                             -সূরা তওবা, ৫৩-৫৪
কাফিরদের সাথে হাশর অনুষ্ঠিতঃ নবীজি বলেন, ‘যে সালাত সংরক্ষণ করবে, তা কিয়ামতের দিন তার জন্য আলোকবর্তিকা ও মুক্তির কারণ হবে। অন্যদিকে যে নামাজ সংরক্ষণ করবে না তা তার জন্য আলোকবর্তিকা ও নাজাতের কারণ হবে না। বরং কিয়ামতের দিন সে কারুন, ফিরাউন, হামান ও উবাই ইবনে খালফের সাথে উঠবে।’
-আহমাদ, দারেমী, বায়হাকী, মিশকাত, হা- ৫৭৮
সালাতের হিফাযত হল, রুকু, সিজদা ইত্যাদি ফরয ও সুন্নাতসমূহ সঠিকভাবে ও গভীর মনোযোগসহ আদায় করা।
-মিরকাত, ২/১১৮ পৃ.
হাফিজ ইবনুল কায়্যিম (রাহ. ৭০১-৭৭৩ হি.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অর্থ সম্পদের মোহে নামাজ থেকে দূরে থাকবে তার হাশর হবে মূসা (আ.) এর চাচাতো ভাই কারুনের সাথে। রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে যে নামাজ হতে দূরে থাকবে তার হাশর হবে মিসরের নাফরমান শাসক ফিরাউনের সাথে। মন্ত্রীত্ব বা চাকুরীগত কারণে যে নামাজ হতে দূরে থাকবে তার হাশর হবে ফিরাউনের মন্ত্রী হামানের সাথে। ব্যবসায়িক কারণে যে নামাজ হতে দূরে থাকবে তার হাশর হবে মক্কার ব্যবসায়ী উবাই বিন খালফের সাথে।’
-আস সালাত ওয়া হুকমু তারিকিহা, ৬৩ পৃ.; ফিকহুস সুন্নাহ, ১/৭২
কিয়ামতের দিন কাফির নেতাদের সাথে হাশর অনুষ্ঠিত হওয়ার অর্থ হল, জাহান্নামী হওয়া। শুধু নামাজ ত্যাগ করা নয় বরং নামাযের হিফাযত না করলেও জাহান্নামী হতে হবে। অতএব হে পাঠক, গভীরভাবে ভাবুন!! চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়ঃ সালাত ত্যাগ কুফরি।   -মুসলিম, মিশকাত, হা-৫৬৯, ৫৭৪, মিরআত, ২/২৭১
সাহাবীরাও একে কুফরী জানতেন।
-তিরমিযী, মিশকাত, হা- ৫৭৯, মিরআত, ২/২৮৩
এরা জাহান্নামী। তবে কালিমা অস্বীকারকারী কাফিরদের ন্যায় চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়। শর্ত হল, তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত বিশ্বাস করতে হবে, ইসলামের হালাল-হারাম, ফরয-ওয়াজিব বিশ্বাস করতে হবে, শিরক করা যাবে না। এরা কর্মগত কাফির, বিশ্বাসগত কাফির নয়। এরা কালিমার বরকতে ও কবীরা গুনাহগারদের জন্য নবীজির শাফায়াতের ফলে শেষ পর্যায়ে জান্নাতে যাবে।              -বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, হা-৫৫৭৩-৫৫৭৪
তবে তারা জাহান্নামী বলে পরিচিত হবে।
-বুখারী, মিশকাত, হা-৫৫৮৫
ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯ হি.), ইমাম শাফেয়ী (র. ১৫০-২০৪ হি.)সহ অধিকাংশ আলিমের মত হল, নামাজ ত্যাগকারী ফাসিক এবং তাকে তাওবা করতে হবে। যদি সে তাওবা করে নামাজ আদায় শুরু না করে তাহলে তার শাস্তি হল, মৃত্যুদন্ড। ইমাম আবু হানিফা (রা. ৮০-১৫০হি.) বলেন, তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে এবং নামাজ আদায় না করা পর্যন্ত জেলখানায় আবদ্ধ করে রাখতে হবে।    -ফিকহুস সুন্নাহ, ১/৭৩, নায়নুল আওতার, ২/১৩
ইমাম আহমদ (রা. ১৬৪-২৪১ হি.) বলেন, ঐ ব্যক্তিকে নামাযের জন্য ডাকার পরেও যদি সে অস্বীকার করে ও বলে যে, আমি নামাজ আদায় করব না এবং এভাবে নামাযের ওয়াক্ত শেষ হয় তখন তাকে হত্যা করতে হবে।
-মিশকাত, ২/১১৩, নায়নুল আওতার, ২/১৫
এ বিধান ইসলামী সরকার বাস্তবায়ন করবে। ঐ ব্যক্তির জানাযা ইমাম বা বড় আলিম পড়বে না। সাধারণ লোক পড়বে।
-ফাতাওয়ায়ে নযীরিয়া, ১/৩৯৬
রাসূল (সা.) সামান্য গনিমতের মালের খেয়ানতকারী এবং আত্মহত্যাকারীর জানাযা পড়েননি। অন্যদের পড়তে বলেন।
-আহমদ, নায়ল, ৫/৪৭, মুসলিম, মিশকাত, হা-৪০১১
ফরয নামাযের খেয়ানতকারী ব্যক্তির ব্যাপারে কেমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে মুমিন পাঠক, গভীরভাবে ভাবুন!! বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রাহ.) বলেন, যারা মোটেই নামাজ পড়ে না ঐসব বেনামাজীদের মুসলিমদের কবরস্থানে কবর দিয়ো না এবং জানাযা পড়ো না।                           -গুনইয়াতুত তলেবীন, ৭১৭ পৃ.
ইমাম আবদুল ওয়াহহাব শাআরানিও (রাহ.) এ ধরনের কথা বলেছেন।

Source: http://www.mashikdeendunia.com

রূহওয়ালা নামাজ : পরিচয় ও প্রকৃতি


রূহওয়ালা নামাজ : পরিচয় ও প্রকৃতি

- মাওলানা আব্দুর রশিদ

খাস সালিকের নামায
সৌভাগ্যের পথের পথিকদের নামায হলো-যখন নামাযের দিকে মনোনিবেশ করবে এবং বাহ্যিক পবিত্রতা হাসিল করতে থাকবে, তখন অন্তরকে তাওবা ও ইস্তেগফারের পানি দ্বারা খুব ভালোভাবে ধৌত করতে হবে। আর যখন মসজিদ কিংবা জায়নামাযে দাঁড়াবে, তখন অন্তরকে গায়রুল্লাহ্র কল্পনা থেকে পাক-পবিত্র করবে। নিজে যেমন কেবলামুখী হও, তেমনি অন্তরের মুখ ও বাতেনী তাওয়াজ্জুহকেও আল্লাহ্র দিকে নিবে। যখন তাকবীর বললে, তখন দুনিয়া ও আখেরাত থেকে পৃথক হয়ে তাকবীর বলবে, আর যখন নামাযে দাঁড়াবে, তখন আল্লাহ্কে হাজির নাযির জেনে অত্যন্ত আদবের সাথে দাঁড়াবে। অত:পর কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করবে।
যখন রুকু করবে তখন অত্যন্ত দীনতা-হীনতার সাথে মাথানত করবে। নিজেকে অকর্মা ও দুর্বল জ্ঞান করবে, আমিত্বভাব বর্জন করবে। আর যখন সিজদা করবে তখন নিজের অপারগতা ও আল্লাহ্ পাকের বড়ত্ব ও মহত্বের পরিপূর্ণ খেয়াল রাখবে। নামাযের আরকান শেষ করে যখন বসবে, তখন অত্যন্ত মনোযোগের সাথে তাশাহহুদ ও দরূদ পড়বে। আর যখন সালাম ফেরাবে তখন নিজের আমিত্বভাবকে বর্জন করে আল্লাহ্র একত্ববাদ কল্পনা করতে থাকবে; যাতে নামাযের বরকতে নামাযীর আত্মা আলমে কুদস তথা পবিত্র জগতে উন্নতি লাভ করতে পারে এবং নামাযের হকীকত তার চেহারার সামনে এসে যায়। মাওলানা রূমী (রাহ.) বলেন- এ নামাযই শাহী মুকুট তোমার মাথায় রাখে; তোমাকে তোমার আমিত্বভাব থেকে রক্ষা করে। নামাযে তুমি তোমার অস্তিত্ব বিলীন করে দাও। তবেই তুমি আল্লাহ পাকের সংঙ্গে ভেদের কথা বলতে পারবে।
আরিফীনদের নামায
আরিফীনদের নামায হলো, আরিফের শরীর ইবাদতে থাকবে, অন্তর আল্লাহ্র দরবারে হাজির থাকবে। জান আল্লাহ্র মহববত ও নৈকট্যে ব্যস্ত থাকবে, নফস ফানাফিল্লায় থাকবে। আরিফে কামিল যখন নামাযে দাঁড়ায়, তখন আল্লাহু আকবার বলেই সে নিজ থেকে হারিয়ে যায় এবং আল্লাহ্ পাকের সামনে হাজির হয়। সে অস্তিত্বহীনতায় এমনভাবে ডুবে যায় যে, তখন নিজ সত্ত্বা সম্পর্কে কোন খবর থাকে না। মানবীয় কোনো বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে অবশিষ্ট থাকে না। কারণ আল্লাহ্ পাক থেকে তাঁর অন্তরে এত ফয়েজ ও বরকত নাযিল হয়, যা তাকে অস্তিত্বহীন করে দিয়ে আল্লাহ্র দরবারে হাজির করে। জনৈক বুযুর্গ বলেছেন- নামাযে তুমি এমনভাবে মগ্ন হবে যে, তোমার অস্তিত্বের খবর থাকবে না। এ নামায সেই হাজারো নামাযের চেয়ে উত্তম, যাতে নিজের অস্তিত্বের উপলব্ধি থাকে। নামাযের হাকীকত সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রকাশ পায়, যে তার অস্তিত্ব বিলীন করে আল্লাহ্র দরবারে স্থায়িত্ব লাভ করে।
শায়খ মুহিউদ্দিন (রহ.) বলেছেন- সাধারণ মানুষের নামায বাহ্যিক অঙ্গের প্রতি খেয়াল রাখা, আর খাছ লোকদের নামায হলো আল্লাহ্ পাক ব্যতীত সকল বস্ত্ত থেকে বিমুখ হওয়া এবং আল্লাহ্র মুশাহাদার সমুদ্রে ডুবে যাওয়া। তরীকতের পথে চলমান শরীয়তের ময়দানের যারা সাওয়ার, তারা নামাযের মাধ্যমে এত উন্নতি লাভ করে যা বর্ণনা করে শেষ করার মতো নয়। বরং সুলুকের লাইনের মুবতাদী তথা আরম্ভকারীদের যেরূপ যিকির ও ফিকিরের দ্বারা উন্নতি লাভ হয়, তদ্রূপ মুনতাহীদের উন্নতি নামাযের সঙ্গেই সম্পর্কিত। কামেল সালিকদের ইবাদতের সর্বশেষ স্তর হলো- অনুনয় বিনয়ের সহিত নামায আদায় করা।
নামাযে অলসতাকারী
আল্লামা ইবনুল কাইয়ূম জাওযী (রাহ.) নামাযীদের পাঁচটি স্তরের কথা উল্লেখ করেছেন :
ক. মুতাহাবিঃ অর্থাৎ যে নামাযে অলসতা করে। মন চায় তো নামায পড়ে, না হয় নামায পড়ে না। কখনো জামাতের সাথে পড়ে আবার কখনো জামাত ছাড়া পড়ে। এদিক দিয়ে সূর্যোদয় হচ্ছে, আর ওদিক দিয়ে সে সেজদায় আছড়ে পড়ছে- এমন নামাযীর ঠিকানা হবে জাহান্নাম। এমন নামাযীদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ রাববুল আলামীন ইরশাদ করেছেন- ধ্বংস নামাযীদের জন্য। সে নামাযী কারা? এ সম্পর্কে আল্লাহ্পাক পরবর্তী আয়াতে বলেন- ‘‘যারা নামাযে অলসতা করে।’’
এছাড়া হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, জাহান্নামের একটি কুপের নাম ওয়াইল, যার মধ্যে নামাযে অলসতাকারীদের নিক্ষেপ করা হবে। এতো হলো নামাযে অলসতাকারীদের শাস্তি, আর বেনামাযীদের জন্য রয়েছে আরো কঠিন শাস্তি।
খ. মুয়াকিবঃ মুয়াকিব ঐ নামাযীদেরকে বলা হয় যারা নামায গুরুত্বের সঙ্গেই পড়ে, কিন্তু তাকবীরে তাহরীমা থেকে সালাম ফিরানো পর্যন্ত ডাক্তার তার ক্লিনিক থেকে বের হয় না, জমিদার তার জমীন থেকে বের হয় না, দোকানদার তার দোকান থেকে বের হয় না। তারা এমন নামাযী যে, তাদের সারা নামাযে একবারও আল্লাহ্র কথা স্মরণ হয় না। এ নামাযীরা নামাযের বরকতও নামাযের প্রতি গুরুত্বারোপের কারণে রক্ষা পেয়ে যাবে ঠিকই, তবে পরবর্তীতে ধমক খেতে হবে এবং সামান্য শাস্তি ভোগ করতে হবে। কারণ তারা বাদশার দরবারে আসার আদব জানে না। আপনি একটু চিন্তা করুন, আমি আপনার সঙ্গে কথা বলবো আর আপনি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকবেন- আমি মানুষ হয়ে এটা সহ্য করতে পারি না। তাহলে আল্লাহ্পাক কীভাবে সহ্য করবেন?
গ. তৃতীয় স্তরের নামাযী হলো, যারা নামাযের অবস্থায় কখনো দোকানে কখনো আল্লাহ্র সামনে থাকে। এমন নামাযীদের সঙ্গে আল্লাহপাক ক্ষমার আচরণ করবেন। তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত। আল্লাহ্ পাক বলবেন, তারা তো নামায ঠিক করে পড়ার জন্য চেষ্টা করেছে।
প্রিয় বন্ধুগণ! কতো আফসোসের বিষয়- আল্লাহ্ বলার সময়ও আল্লাহ্ আমাদের স্মরণে আসে না। কী মারাত্মক অবহেলা! পয়সার নাম মুখে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরসার আকৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অথচ নামাযে আল্লাহ পাকের নাম মুখে নেয়ার সময় আল্লাহ্পাক খেয়ালে আসে না। কত বড় আফসোসের কথা।
ঘ. চতুর্থ স্তর হলো- মুসল্লী আল্লাহু আকবর বলে সৃষ্টিজীব থেকে পৃথক হয়ে যায়। তাদের ব্যাপারেই আল্লাহ্পাক বলেছেন- ‘‘খুশু খুযুর সহিত নামায আদায়কারী মুমিনগণ সফলকাম।’’ এরূপ নামায যাদের অর্জন হবে তাদের যিন্দেগী পরিবর্তন হয়ে যাবে।
হযরত আলী (রা.) এর পায়ের গোড়ালীতে তীরবিদ্ধ হওয়ার পর বললেন, আমি যখন নামাযে পড়তে থাকি তখন এটা টেনে বের করবে। অত:পর তিনি যখন নামাযে দাড়ালেন, তখন পায়ের গোড়ালী থেকে তীর টেনে বের করা হয়। কিন্তু তিনি টেরও পেলেন না।
হযরত যুবায়ের (রা.) এর পায়ে ফোঁড়া হয়। ক্রমান্বয়ে তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। অবশেষে পা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। ডাক্তার তাকে লক্ষ্য করে বললেন, শরাব পান করিয়ে পা কাটা হলে ব্যথা অনুভব হবে না। তিনি জবাবে বললেন, ঈমান আর শরাব একত্র হতে পারে না। তোমাদের যদি পা কাটতেই হয়, তাহলে আমি নামায শুরু করলে কেটে ফেলো। অত:পর তিনি পা ছাড়িয়ে নামায আরম্ভ করলেন, এদিকে ডাক্তার তার পা কেটে ফেললো। কিন্তু আশ্চর্য, পায়ে সামান্য ঝাঁকুনিও আসেনি। নামায শেষে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, পা কাটা হয়েছে? বলা হলো, হ্যাঁ কাটা হয়েছে। অত:পর তিনি বললেন, হে আল্লাহ্! তুমি সাক্ষী থেকো, আমার এ পা কখনো তোমার নাফরমানীর পথে চলেনি।
ঙ. মুকাররাবীনদের নামাযঃ এ নামাযে যখন নামাযী আল্লাহু আকবার বলে, তখন নামায তার চক্ষু শীতল করে। নামায ব্যতীত সে শান্তি পায় না।
খুন্ড খুযু সম্পর্কে সূফীগণের বক্তব্য
খুশু খুযুর অর্থ: খুশু-খুযু সম্পর্কে সূফীগণের বিভিন্ন উক্তি পাওয়া যায়, তন্মধ্যে কিছু উক্তি তুলে ধরা হলো :
* নামায সম্পর্কে দু’টি শব্দ ব্যবহৃত হয় : এক, খুশু দুই. খুযু। খুশু হলো বাহ্যিক নীরবতা, আর খুযু হলো আন্তরিক নিরবতা। (মাজালিসে মুফতী আযম)।
* অসংখ্য সাহাবী ও তাবেয়ী থেকে বর্ণিত আছে যে, খুশুর অর্থ হলো নীরবতা অর্থাৎ নামায অত্যন্ত স্থিরতার সাথে পড়া। একাধিক হাদীসে হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, নামায এমন ধ্যান-খেয়ালের সাথে পড়বে যেন এটা তোমার জীবনের শেষ নামায। এবং ঐ ব্যক্তির ন্যায় নামায পড় যে ধারণা করে যে, এই নামাযের পর আমার নামায পড়ার সুযোগ আসবে না (জামেউস সাগীর)।
* হযরত আলী (রা.) এর কাছে জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন-খুশু কী জিনিস? জবাবে তিনি বললেন, খুশু দিলের বিষয়, অর্থাৎ গভীরভাবে নামাযে মনোনিবেশ করা এবং অন্যদিকে খেয়াল না করা।
* হযরত ইবনে আববাস (রা.) বলেন, খুশু ওয়ালা সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহ্কে ভয় করে এবং স্থিরতার সহিত নামায আদায় করে। (ফাযায়েলে নামায)
* হযরত হুযায়ফা (রা.) বলেন, দুনিয়া থেকে সর্বপ্রথম নামাযের খুশু উঠিয়ে নেয় হবে।
* হযরত কাতাদা (রা.) বলেন, দৃষ্টি ও আওয়াজ নিচু করার নামই হলো খুশু।
* হযরত আতা (রাহ.) বলেন, শরীরের কোনো অঙ্গ দ্বারা খেলাধূলা না করাই হলো খুশু। -মাআরেফুল কুরআন।
* হযরত হাসান বসরী (রাহ.) ‘খাশিউন’এর অর্থ লিখেছেন-ভীত।
* জনৈক বুযুর্গ লিখেছেন, নামায আল্লাহ্র সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পড়ার নামই খুশু।
* খুশু অর্থ হচ্ছে- ধ্যান খেয়াল অন্য জিনিস থেকে সরিয়ে নামাযে লাগানো এবং কেরাত ও তাসবীহের প্রতি খেয়াল করা।
* হযরত আবু দারদা (রা.) বলেন, যখন নামাযীর মধ্যে এ চারটি বিষয় পাওয়া যাবে তখন তাকে খুশু ওয়ালা বলা হবে: ১. আল্লাহ্র দরবারকে বড় জ্ঞান করা। ২. এখলাছের সহিত কেরাত পড়া। ৩. পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখা। ৪. পূর্ণ মনোযোগের সহিত নামায আদায় করা।
* হযরত ইমাম গায্যালী (রাহ.) বলেন, খুশু-খুযু হলো নামাযের রূহ বা আত্মা। নামায ততটুকুই লেখা হয় যতটুকুতে ক্বলব হাজির থাকে। পক্ষান্তরে যে নামাযে তাকবীরে তাহরীমার সময় ব্যতীত ক্বলব হাজির থাকে না, তাতে সে অনুপাতেই আত্মা থাকে। এরূপ নামাযের দৃষ্টান্ত ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যে এক শ্বাসের মুসলমান।
হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রাহ.) এর বাণীঃ
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা শাহ্ আশরাফ আলী থানভী (রাহ.) বলেন, খুশুর হাকীকত হলো, কোন নেক কাজে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অন্তরে গায়রুল্লাহ্র হাযির না থাকা এবং ইচ্ছাকৃত ভাবে মন কোন দিকে না নেয়া।
(শরীয়ত ও তাসাউফ)
* শাববীর আহমদ উসমানী (রাহ.) বলেন, খুশু বলা হয়, ভীত হয়ে কারো সামনে  নীরব ও স্থির হয়ে থাকা। এ জন্যই ইবনে আববাস (রাহ.) খাশিউন এর তাফসীর করেছেন খা-ইফুন, সা-কিনুন। অর্থ-ভীত ও স্থির।
-তাফসীরে ইসমানী।
তিনি আরো বলেন, আসল খুশু হলো কলবের খুশু, আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের খুশু ক্বলবের অধীনে। সুতরাং নামাযে অন্তর ভীত, স্থির ও নমনীয় হবে, তখন খেয়াল এদিক সেদিক যাবে না। মন বসে যাবে। ভয়-ভীতির প্রভাব অঙ্গ প্রতঙ্গের উপর প্রকাশ পাবে। যেমন বাহু-মাথা ঝুকানো, দৃষ্টি নিম্নগামী হওয়া, হাত বেঁধে আদবের সহিত দাঁড়িয়ে থাকা, এদিক সেদিক না তাকানো, কাপড় এ দাড়ি নিয়ে খেলা-ধুলা না করা, আঙ্গুল না ফুটানো। এ ধরণের কাজ সবই খুশুর অন্তর্ভূক্ত। হযরত আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের ও হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, সাহাবায়ে কেরাম নামাযে এমনভাবে স্থির থাকতেন, যেন প্রাণহীন কাঠ। এটাই হলো নামাযের খুশু।
* হযরত আব্দুল গণী ফুলপুরী (রাহ.) বলেন, খুশু বলা হয়- বান্দার মনে আল্লাহ্ পাকের বড়ত্বের খেয়াল এত বেশি মাত্রায় থাকবে যে, সে দুর্বল হয়ে যাবে। নামাযে দাঁড়ানো ও রুকু-সিজদা করা মানে নামাযী ব্যক্তি আল্লাহ্র বড়ত্বের সামনে অত্যন্ত দুর্বল। এ অবস্থা কেবল সে সকল লোকদের ভাগ্যে জোটে, যারা অনর্থক কথা-বার্তা থেকে বেঁচে থাকে এবং সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহ্র নাফরমানী থেকে বাঁচিয়ে রাখে। যে ব্যক্তি নামাযের বাইরে নিজের দাসত্ব ও গোলামীর হক আদায় করে, সে নামাযের ভেতরেও দাসত্বের মুকুট মাথায় রাখে। পাঞ্জেগানা নামাযের আগে পরেও বান্দা গোলাম থাকে। নামায আদায়ের পর বান্দা আযাদ বা মুক্ত নয় যে, মন যা চায় তাই করবে। মিথ্যা বলা, পর নারীর প্রতি কুদৃষ্টি, আল্লাহ্র স্মরণ থেকে গাফেল হওয়া, হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করে উপার্জন করা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হবে। বান্দা তো সবসময়ই বান্দা। গোলাম সর্বদাই গোলাম। তার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসই গোলাম।      (মারেফাতে ইলাহিয়্যা)।
* হযরত থানবী (রাহ.) বলেন, খুশুর অর্থ হলো ইচ্ছাকৃতভাবে ক্বলব ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে স্থির রাখা, নাড়াচাড়া না করা। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্থিরতা হলো, শরীয়তে যে নাড়াচড়া করার হুকুম নেই তা না করা। অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত হাত-পা নাড়াচাড়া না করা, এদিক সেদিক মাথা না ঘুরিয়ে দেখা, মাথা উপরের দিকে না উঠানো, চুল ও কাপড় বার বার না গুছানো, বিনা প্রয়োজনে না চুলকানো এবং কাশি না দেয়া ইত্যাদি।
আর ক্বলবের স্থিরতা হলো নিজ ইচ্ছায় কোনো বিষয়ে চিন্তা না করা। অনিচ্ছায় যদি কোন খেয়াল এমনিতেই এসে যায়, সেটা খুশুর পরিপন্থি নয়। মানুষ মনে করে, খুশুর অর্থ হলো নামাযে অন্য কোন কিছুর খেয়াল না আসা। এটা ভুল ধারণা। উল্লিখিত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, খুশু মূলত ইচ্ছাধীন কাজ, আর প্রত্যেক ব্যক্তিই এটা অর্জন করতে সক্ষম। তবে গভীর মনোনিবেশ জরুরী।
কুরআনের আলোকে খুশু
আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন
১. আল্লাহ্র দরবারে বিনয়ের সহিত দাড়াও।
(সূরা বাকারা আয়াত : ১৯৮)
উল্লেখিত আয়াতের তাফসীর সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত রয়েছে :
* ‘কানিতীন’ শব্দের অর্থ হলো, নীরবতা অবলম্বনকারী। ইসলামের প্রথম যুগে নামাযের ভিতর কথা বলা, সালামের জবাব দেয়া ইত্যাদি কাজ জায়েয ছিলো। অত:পর যখন উল্লেখিত আয়াত নাযিল হয়, তখন নামাযের ভিতর কথা বলা না জায়েয হয়ে যায়।
* হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন, প্রিয়নবী (সা.) নামাযে মশগুল থাকলেও আমি এসে সালাম দিতাম, তিনি আমার সালামের জবাব দিতেন। একদা নবীজির কাছে হাজির হয়ে দেখতে পেলাম, তিনি নামায পড়ছেন। আমি আমার পূর্বের অভ্যাস অনুযায়ী তাঁকে সালাম করলাম, কিন্তু তিনি আমার সালামের জবাব দিলেন না। ফলে আমি খুব চিন্তিত হলাম যে, হয়তো আমার অপরাধ সম্পর্কে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নবীজির প্রতি কোন কিছু নাযিল হয়েছে। নতুন পুরাতন অনেক চিন্তা-ভাবনা আমাকে ঘিরে ধরলো। আমি পুরাতন বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম যে, হয়তো আমার অমুক কাজের উপর নবী অসন্তুষ্ট হয়েছেন। অবশেষে নবীজি (সা.)  নামায শেষে সালাম ফিরিয়ে বললেন, আল্লাহ্ রাববুল আলামীন তাঁর বিধানে যে কোন ধরণের পরিবর্তন আনতে পারেন। আল্লাহ তায়ালা নামাযে কথা বলতে নিষেধ করেছেন। তারপর ‘‘ওয়াকূমূ লিল্লাহি ক্বানিতীন’’ এ আয়াত পড়ে শুনালেন। অত:পর বললেন, নামাযে আল্লাহ্র যিকির ও হামদ-ছানা ব্যতীত সবই নাজায়েয।
* মুজাহিদ (রাহ.) বলেন, ‘‘ওয়াকূমু লিল্লাহি ক্বানিতীন’’ এ আয়াতের মধ্যে রুকু, খুশু, লম্বা কেরাত পড়া, দৃষ্টি নিম্নগামী রাখা, বাহু ঝুকিয়ে রাখা, আল্লাহকে ভয় করা ইত্যাদি সবই অন্তর্ভূক্ত। হযরত সাহাবায়ে কেরাম নামাযে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক তাকানো, কংকর সরানো ইত্যাদি কাজ করা দূরের কথা, তারা তো ভয়ে কাতর হয়ে যেতেন। তবে হ্যাঁ, ভুলে কোন কিছু করে ফেলা ভিন্ন কথা।
আল্লাহপাক আরো ইরশাদ করেন-
২. কিয়ামতের দিন সকল মুমিনগণ সফলকাম হবে, যারা খুশু তথা বিনয়ের সাথে নামায আদায়কারী। সূরা মুমিনুন ১-২।
আয়াতের পটভূমি
উল্লেখিত আয়াত নাযিল হওয়ার পর হযরত রাসূলে করীম (সা.) মাথা নিচের দিকে ঝুকিয়ে নিলেন। অন্য এক রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (সা.) আকাশের দিকে তাকিয়ে এদিক সেদিক মাথা ঘুরাতেন; তখন এই আয়াত নাযিল হয়। বগভী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, সাহাবায়ে কেরাম নামাযের ভিতরে আকাশের দিতে তাকিয়ে থাকতেন। তারপর যখন এ আয়াত নাযিল হল, তখন তাঁরা মাথা নিম্নগামী করে নিলেন।
এ সূরা হিজরতের পূর্বে মক্কা মুকাররমায় নাযিল হয়েছে। ইমাম আহমদ, ইমাম নাসায়ী ও ইমাম তিরমিযী (রাহ.) এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। হাদীসের সর্ব শেষ বাক্য হলো- ওহী নাযিল হওয়ার পর হযরত রাসূলে করীম (সা.) মাথা উঠিয়ে বললেন, আমার উপর এখন দশটি আয়াত নাযিল হয়েছে। যে ব্যক্তি এ আয়াতগুলোর প্রতি আমল করবে, আল্লাহ্পাক স্বয়ং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।

সূত্র : মাসিক আল ফারুক, এপ্রিল ২০১০ইং সংখ্যা, সিলেট।

Saturday, September 28, 2013

নামাজে একাগ্রতা অর্জনের গুরুত্ব ও উপায়

নামাজে একাগ্রতা অর্জনের গুরুত্ব ও উপায়

- আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব

 

ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হ’ল নামাজ। সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণকে হৃদয়ে সঞ্চারিত রাখার প্রক্রিয়া হিসাবে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরয করেছেন। আল্লাহ বলেন- ‘আর তুমি নামাজ কায়েম কর আমাকে স্মরণ করার জন্য’। [ত্বোয়া-হা ২০/১৪]
আর প্রতিটি কাজে সফলতার জন্য মৌলিক শর্ত হল একাগ্রতা ও একনিষ্ঠতা। আর এ বিষয়টি নামাজের ক্ষেত্রে আরো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইবাদতের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদনের জন্য একাগ্রতার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে এই ব্যস্ত যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে একাগ্রচিত্তে নামাজ আদায় করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ একাগ্রতাবিহীন নামাজ  শুধুমাত্র দায়সারা ও শারীরিক ব্যায়ামের উপকারিতা ব্যতীত তেমন কিছুই বয়ে আনে না। হৃদয়ে সৃষ্টি করে না প্রভুর একান্ত সান্নিধ্যে কিছু সময় অতিবাহিত করার অনাবিল প্রশান্তি। সঞ্চারিত হয় না নেকী অর্জনের পথে অগ্রগামী হওয়ার এবং যাবতীয় অশ্লীলতা ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার কোন অনুপ্রেরণা। সার্বিক অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে রাসুল সা.-এর নিম্নোক্ত হাদিসটি একটি কঠিন বাস্তবে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এই উম্মত হতে সর্বপ্রথম নামাজের একাগ্রতাকে উঠিয়ে নেয়া হবে, এমনকি তুমি তাদের মধ্যে কোন একাগ্রচিত্ত মুসল্লি খুঁজে পাবে না’। [ত্বাবারাণী; ছহিহুল জামে‘ হা/২৫৬৯]
একই বক্তব্য প্রতিধ্বনিত হয়েছে হুযায়ফা রা.-এর নিম্নোক্ত বাণীতে। তিনি বলেন, ‘সর্বপ্রথম তোমরা নামাজে একাগ্রতা হারাবে। অবশেষে হারাবে নামাজ।
অধিকাংশ নামাজ  আদায়কারীর মধ্যে কোনো কল্যাণ অবশিষ্ট থাকবে না। হয়তো মসজিদে প্রবেশ করে একজন বিনয়ী-একাগ্রতা সম্পন্ন নামাজ  আদায়কারীকেও পাওয়া যাবে না’।  [ইবনুল ক্বাইয়ম, মাদারিজুস সালেকীন বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, ১৯৯৬), ১/৫১৭ পৃঃ]
বস্তুতঃ খুকূবিহীন নামাজ বান্দাকে অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখে না। তাইতো আল্লাহ তাআলা একাগ্রচিত্তের অধিকারী মুসল্লিদেরকেই সফল মুমিন বলে আখ্যায়িত করেছেন। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে নামাজে একাগ্রতার প্রয়োজনীয়তা, ফজিলত এবং একাগ্রতা সৃষ্টির কিছু উপায় সংক্ষেপে আলোচিত হল।
খুশু বা একাগ্রতার পরিচয়
‘খুশু’-এর আভিধানিক অর্থ হ’ল দীনতার সাথে অবনত হওয়া, ধীরস্থির হওয়া ইত্যাদি। ইবনু কাছীর বলেন, খুশু অর্থ- স্থিরতা, ধীরতা, গাম্ভীর্য, বিনয় ও নম্রতা।
ইবনুল ক্বাইয়ম বলেন, খুশু হল হৃদয়কে দীনতা ও বিনয়ের সাথে প্রতিপালকের সম্মুখে উপস্থাপন করা। [মাদারিজুস সালেকিন ১/৫১৬]
প্রত্যেক ইবাদত কবুল হওয়া এবং তার প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করার আবশ্যিক শর্ত হল খুশু। আর শ্রেষ্ঠ ইবাদত নামাজের ক্ষেত্রে এর আবশ্যিকতা যে কত বেশি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘তোমরা আল্লাহর সম্মুখে দণ্ডায়মান হও বিনীতভাবে’ [বাকারাহ ২/২৩৮]
তিনি আরো বলেন, ‘ঐ সকল মুমিন সফলকাম, যারা নামাজে বিনয়াবনত’ [মুমিনুন ২৩/১-২]
খুশু বা একাগ্রতার স্থান হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশে, কিন্তু এর প্রভাব বিকশিত হয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে। অন্যমনস্ক হওয়ার দরুন আত্মিক জগতে বিঘœ সৃষ্টি হলে বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও তার কুপ্রভাব পড়ে। তাই হৃদয় জগতকে একাগ্রতা ও একনিষ্ঠতায় পরিপূর্ণ করতে সক্ষম হলেই নামাজের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া সম্ভব।
নামাজের মধ্যে খুকূ কেবল তারই অর্জিত হবে, যে সবকিছু ত্যাগ করে নিজেকে শুধুমাত্র নামাজের জন্য নিবিষ্ট করে নিবে এবং সবকিছুর ঊর্ধ্বে নামাজকে স্থান দিবে। তখনই নামাজ তার অন্তরকে প্রশান্তিতে ভরে দিবে। রাসুলুল্লাহ সা. বলতেন, ‘নামাজেই আমার চোখের প্রশান্তি রাখা হয়েছে’।  [আহমাদ, মিশকাত হা/৫২৬১, সনদ হাসান]
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে মনোনীত বান্দাদের আলোচনায় ‘খুশু-খুযু’র সাথে নামাজ আদায়কারী নারী-পুরুষের কথা উল্লেখ করেছেন এবং তাদের জন্য নির্ধারিত ক্ষমা ও সুমহান প্রতিদানের ঘোষণা দিয়েছেন [আহযাব ৩৩/৩৫]
‘খুশু’ বান্দার উপর নামাজের এই কঠিন দায়িত্বকে স্বাভাবিক ও প্রশান্তিময় করে তোলে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয়ই তা বিনয়ী-একনিষ্ঠ ব্যতীত অন্যদের উপর অতীব কষ্টকর’ [বাক্বারা ২/৪৫]
বস্তুত যে কোনো ইবাদতের ক্ষেত্রে যখন রাসুল সা.-এর নিম্নোক্ত বাণীর অনুসরণ করা হবে, তখনই তা এক সফল ইবাদতে পরিণত হবে। হৃদয়জগতকে অপার্থিব আলোয় উদ্ভাসিত করবে। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর ইবাদত কর এমনভাবে, যেন তাঁকে তুমি দেখতে পাচ্ছ। আর যদি দেখতে না পাও, তবে তিনি যেন তোমাকে দেখছেন’।  [বুখারি হা/৫০; মুসলিম হা/৮; মিশকাত হা/২]
একাগ্রতাপূর্ণ নামাজের ফজিলত
খুশু-খুযু পূর্ণ নামাজ আদায়কারীর মর্যাদা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা পাঁচওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন। অতএব যে ভাল করে অজু করবে, সময় মত নামাজ  আদায় করবে এবং রুকু-সিজদা সঠিকভাবে আদায় করবে, আল্লাহর দায়িত্ব তাকে ক্ষমা করে দেওয়া। আর যে এমনটি করবে না, তার প্রতি আল্লাহর কোন দায়িত্ব নেই। তিনি শাস্তিও দিতে পারেন, ক্ষমাও করতে পারেন’।  [আহমাদ, আবুদাউদ হা/৪২৫; মিশকাত হা/৫৭০]
রাসুল সা. আরো বলেন, ‘যে সুন্দরভাবে অজু করে, অতঃপর মন ও শরীর একত্র করে (একাগ্রতার সাথে) দু’রাকআত নামাজ আদায় করে, (অন্য বর্ণনায় এসেছে- যে নামাজে ওয়াসওয়াসা স্থান পায় না) তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়। (অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়)।  [নাসাঈ হা/১৫১; বুখারি হা/১৯৩৪; মিশকাত হা/২৮৭]
খুকূ ও একাগ্রতা অর্জনের উপায়
নামাজে একাগ্রতা অর্জনের উপায়গুলি দু’ভাগে বিভক্ত-
(১) একাগ্রতা সৃষ্টি ও তা শক্তিশালীকরণের পদ্ধতি গ্রহণ করা।
(২) ‘খুশু’ ও ‘খুজু’তে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বিষয়গুলো পরিহার করা।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, দু’টি বস্তু ‘খুশু’র জন্য সহায়ক। প্রথমটি হ’ল মুসল্লি যা বলবে, যা করবে; তা অনুধাবন করবে। স্বীয় তেলাওয়াত ও দোয়াসমূহ গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করবে। সর্বদা হৃদয়ে জাগরুক রাখবে যে, সে আল্লাহর সম্মুখে প্রার্থনারত এবং তিনি তাকে দেখছেন। কেননা নামাজরত অবস্থায় মুসল্লি আল্লাহর সাথেই কথপোকথন করে। হাদিসে জিবরিলে ইহসানের সংজ্ঞায় এসেছে, ‘আল্লাহর ইবাদত কর এমনভাবে, যেন তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। যদি তুমি দেখতে না পাও, তবে তিনি তোমাকে দেখছেন’।  [বুখারি হা/৫০; মুসলিম হা/৮; মিশকাত হা/২]
এভাবে মুসল্লি যতই নামাজের স্বাদ আস্বাদন করবে, ততই নামাজের প্রতি তার আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। এটা নির্ভর করে তার ঈমানি শক্তির উপর। আর তা বৃদ্ধি করার অনেক উপকরণ রয়েছে।
রাসুল সা. বলতেন, ‘আমার জন্য প্রিয়তর করা হয়েছে নারীও সুগন্ধি। আর নামাজকে করা হয়েছে আমার চোখের প্রশান্তি’।  [আহমাদ, নাসাঈ; মিশকাত হা/৫২৬১]
অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুল সা. বেলাল রা.-কে উদ্দেশ্য করে বলছেন,  ‘হে বেলাল, নামাজের একামত দাও, আমাদেরকে প্রশান্তি দাও’।  [আবুদাঊদ, মিশকাত হা/১২৫৩]
দ্বিতীয়টি হ’ল প্রতিবন্ধকতা দূর করা। অন্তরের একাগ্রতা বিনষ্টকারী বস্তু ও অপ্রয়োজনীয় চিন্তা-ভাবনা পরিহার করা এবং নামাজের মৌলিক উদ্দেশ্য ব্যাহতকারী সকল আকর্ষণীয় বস্তুকে পরিত্যাগ করা।
একাগ্রতা সৃষ্টি ও শক্তিশালী করণের উপায়সমূহ
(১) নামাজের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ
নামাজে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য প্রথমতঃ নিজেকে নামাজের জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে। যেমন মুওয়াজ্জিন আযান দিলে তার জওয়াব দেওয়া, আযান শেষে নির্দিষ্ট দো‘আ পড়া, অতঃপর বিসমিল্লাহ বলে সঠিকভাবে ওযূ করা, ওযূর পরে দোয়া পড়া ইত্যাদি। মুখ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য মিসওয়াকের প্রতি যতœশীল হওয়া আবশ্যক। রাসুল সা. বলেছেন, ‘বান্দা যখন নামাজের জন্য দণ্ডায়মান হয় এবং তেলাওয়াত করে, ফেরেশতা তার পিছনে দাঁড়িয়ে তেলাওয়াত শুনতে থাকে এবং শুনতে শুনতে তার নিকটবর্তী হয়। অবশেষে সে তার মুখকে বান্দার মুখের সাথে লাগিয়ে দেয়। ফলে সে যা কিছু তেলাওয়াত করে, তা ফেরেশতার মুখগহবরেই পতিত হয়। অতএব, ‘তোমরা (নামাজে) কুরআন তেলাওয়াতের জন্য মুখকে পরিচ্ছন্ন কর’। [বায়হাকি, বাযযার;  সিলসিলা ছহিহাহ হা/১২১৩]
অতঃপর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সুগন্ধিযুক্ত পোষাক পরিধান করে নামাজের জন্য বের হবে। যা মুসল্লির হৃদয়ে অনাবিল প্রশান্তি বয়ে আনে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা নামাজের সময় সুন্দর পোষাক পরিধান কর’ [আ‘রাফ ৭/৩১]
এছাড়া নামাজের স্থানকে পবিত্র করা, ধীর-স্থিরভাবে মসজিদে গমন, পায়ে পা, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাতার সোজা করে দাঁড়ানো প্রভৃতি বিষয়গুলিও নামাজে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য কার্যকর।
(২) ধীর-স্থিরতা অবলম্বন করা
নামাজে একাগ্রতা আনার জন্য ধীর-স্থিরতা অবলম্বন করা আবশ্যক। রাসুল সা. প্রত্যেক অঙ্গ নিজ নিজ স্থানে ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন।  [আবুদাঊদ, ছিফাতু সালাতিন্নাবি ১/১৩৪]
নামাজে ভুলকারী ব্যক্তিকে তিনি ধীরে-সুস্থে নামাজ আদায় করার শিক্ষা দিয়ে বলেন, ‘এভাবে আদায় না করলে তোমাদের কারো নামাজ শুদ্ধ হবে না’।  [আবুদাঊদ হা/৮৫৮, সনদ ছহীহ]
আবু কাতাদা রা. হ’তে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেছেন, ‘নিশৃষ্টতম চোর হ’ল সেই ব্যক্তি, যে নামাজে চুরি করে। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! নামাজে কিভাবে চুরি করে?  তিনি বললেন, ‘যে রুকু-সিজদা পূর্ণভাবে আদায় করে না’।  [আহমাদ ;:মিশকাত হা/৮৮৫, সনদ ছসহি]
রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি পূর্ণভাবে রুকূ করে না এবং সিজদাতে শুধু ঠোকর দেয়, সে ঐ ক্ষুধার্ত ব্যক্তির ন্যায়, যে দু’তিনটি খেজুর খেল, কিন্তু পরিতৃপ্ত হল না’।  [তাবারানি; সহিহুল জামে হা/৫৪৯২, সনদ হাসান]
এছাড়া রাসুল সা. সংক্ষেপে নামাজ আদায় করতে নিষেধ করেছেন। সাথে সাথে তিনি দীর্ঘ নামাজকে সর্বোত্তম নামাজ বলে আখ্যায়িত করেছেন। [মুসলিম হা/৭৫৬; মিশকাত হা/৮০০]
ধীর-স্থিরতা ব্যতীত একাগ্রতাপূর্ণ সফল নামাজ আদায় করা অসম্ভব। কাকের ন্যায় ঠোকর দিয়ে আদায়শৃত নামাজে একদিকে যেমন একাগ্রতা থাকে না, অন্যদিকে তেমনি নেকী অর্জনও সুদূর পরাহত হয়ে পড়ে।
(৩) নামাজে মৃত্যুকে স্মরণ করা
রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘তুমি নামাজে মৃত্যুকে স্মরণ কর। কারণ যে ব্যক্তি নামাজে মৃত্যুকে স্মরণ করবে, তার নামাজ যথার্থ সুন্দর হবে। আর তুমি সেই ব্যক্তির ন্যায় নামাজ আদায় কর, যে জীবনে শেষবারের মত নামাজ আদায় করে নিচ্ছে’। [দায়লামী; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৪২১]
রাসুল সা.-এর নিকটে জনৈক ব্যক্তি সংক্ষিপ্ত উপদেশ কামনা করলে তিনি তাকে বললেন, ‘যখন তুমি নামাজে দন্ডায়মান হবে, তখন এমনভাবে নামাজ আদায় কর, যেন এটিই তোমার জীবনের শেষ নামাজ’। [ইবনু মাজাহ; মিশকাত হা/৫২২৬, সনদ হাসান]
মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু তার সময়-ক্ষণ অনিশ্চিত। তাই বান্দাকে তার প্রতিটি নামাজকেই ‘বিদায়ী নামাজ’ হিসাবে আদায় করতে হবে। মনে করতে হবে যে, এটাই তার জীবনের শেষ নামাজ; প্রভুর সাথে একান্ত আলাপের শেষ সুযোগ। সর্বদা এ চিন্তা অন্তরে জাগরূক রাখতে পারলে তার প্রতিটি নামাজই এক বিশেষ নামাজে পরিণত হবে।
(৪) পঠিত আয়াত ও দো‘আ সমূহ গভীরভাবে অনুধাবন করা
নামাজে পঠিত প্রতিটি আয়াত ও দো‘আ গভীর মনোযোগে অর্থ বুঝে পড়তে হবে এবং শুনতে হবে। বিশেষত পঠিত দো‘আ সমূহের অর্থ একান্তভাবেই জানা আবশ্যক। কুরআনের আয়াত সমূহ শ্রবণে যেসব বান্দা প্রভাবিত হয়, তাদের প্রশংসা করে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যারা তাদের রবের আয়াতসমূহ স্মরণ করিয়ে দিলে বধির ও অন্ধদের মত পড়ে থাকে না’ [ফুরকান ২৫/৭৩]
এতদ্ব্যতীত শিক্ষিত ব্যক্তিদের জন্য কুরআনের তাফসীর পাঠ করা উচিত। খ্যাতনামা মুফাসসির ইবনু জারীর তাবারি বলেন, ‘আমি আশ্চর্যান্বিত হই সেই সব পাঠককে দেখে, যারা কুরআন পাঠ করে অথচ তার মর্ম জানে না। সে কিভাবে এর স্বাদ পাবে’?  [মাহহুদ শাকের কর্তৃক তাফসিরে তাবারানি ভূমিকা ১/১০]
একটি আয়াত বার বার পাঠ করা এবং সে সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করাও নামাজে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আবু যর গিফারী রা. হ’তে বর্ণিত, রাসুল সা. একদিন তাহাজ্জুদ নামাজে কেবলমাত্র ‘যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করেন তবে তারাতো আপনারই বান্দা, আর তাদেরকে যদি ক্ষমা করেন, তবে নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ [মায়েদাহ ৫/১১৮] -এই আয়াতটি পড়তে পড়তেই রাত শেষ করেছিলেন। [নাসাঈ, ইবনু মাজাহ; মিশকাত হা/১২০৫, সনদ ছহীহ]
হুযায়ফা রা. হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,
‘আমি রাসুলুল্লাহ সা.-এর সাথে কোন এক রাতে নামাজ পড়েছিলাম। লক্ষ্য করলাম, তিনি একটি একটি করে আয়াত পড়ছিলেন। যখন আল্লাহর প্রশংসামূলক কোন আয়াত আসত, আল্লাহর প্রশংসা করতেন। যখন প্রার্থনা করার আয়াত আসত, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন। যখন আশ্রয় চাওয়ার আয়াত আসত, আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইতেন’।  [মুসলিম হা/৭৭২]
নামাজে  আয়াত  সমূহ  অনুধাবন  করা  ও তার ফলাফলের বাস্তবতা জানার জন্য নিম্নোক্ত হাদীছটিও প্রণিধানযোগ্য।
আতা রা. বলেন, একদা আমি ও উবাইদ ইবনে ওমায়ের রা. আয়েশা রা.-এর নিকটে গমন করি। উবাইদ আয়েশাকে অনুরোধ করলেন, আপনি আমাদেরকে রাসুল সা.-এর একটি অতি আশ্চর্যজনক ঘটনা শুনান। আয়েশা রা. এ কথা শুনে কেঁদে ফেললেন। অতঃপর বললেন, এক রাতে উঠে রাসুল সা. আমাকে বললেন, আয়েশা তুমি আমাকে ছাড়, আমি প্রভুর ইবাদতে লিপ্ত হই। আমি বললাম, আল্লাহর কসম, আমি আপনার নৈকট্য যেমন পসন্দ করি এবং আপনার পসন্দের জিনিসও তেমনি পসন্দ করি। আয়েশা রা. বলেন, রাসুল সা. উঠে ওযূ করলেন এবং নামাজে দাঁড়ালেন। অতঃপর কাঁধে আরম্ভ করলেন। কাঁদতে কাঁদতে তার বক্ষ ভিজে গেল। এমনকি এক পর্যায়ে (পায়ের নীচের) মাটি পর্যন্ত ভিজে গেল। বেলাল তাঁকে (ফজরের) নামাজের সংবাদ দিতে এসে দেখেন তিনি কাঁদছেন। বেলাল বললেন, হে আল্লাহর রাসুল সা.! আপনি কাঁদছেন, অথচ আল্লাহ আপনার পূর্বের ও পরবর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন? রাসুল সা. বললেন, হে বেলাল! আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? আজ রাতে আমার উপর কয়েকটি আয়াত (আলেইমরান ১৯০-২০০) নাযিল হয়েছে। ‘যে ব্যক্তি এগুলো পড়বে, কিন্তু চিন্তা-ভাবনা করবে না, সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’। [ছহীহ ইবনু হিববান; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৬৮]
(৫) প্রতিটি আয়াত তেলাওয়াতের পর ওয়াকফ করা
এ পদ্ধতি একদিকে যেমন পঠিত আয়াত সম্পর্কে চিন্তা ও উপলব্ধি করতে সহায়ক হয়, অন্যদিকে তেমনি তা একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য অত্যন্ত কার্যকর। রাসুল সা.-এর কুরআন তেলাওয়াতের ধরন ছিল এরূপ। তিনি প্রতিটি আয়াতের শেষে ওয়াকফ করতেন। [আবুদাঊদ হা/৪০০১, সনদ ছহীহ]
(৬) মধুর স্বরে স্থিরতার সাথে তেলাওয়াত করা
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে কুরআন তেলাওয়াত কর’ [মুযযাম্মিল ৪] রাসুলুল্লাহ সা. প্রতিটি সূরা তারতীল সহকারে তেলাওয়াত করতেন। [মুসলিম হা/৭৩৩, তিরমিযী হা/৩৭৩]
মধুর স্বরে ধীরগতির পড়া খুকূ বা একাগ্রতা সৃষ্টিতে যেমন সহায়ক ভূমিকা পালন করে, তাড়াহুড়ার সাথে দ্রুতগতির পড়া তেমনি একাগ্রতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। রাসুল সা. বলেন,
‘তোমরা সুমধুর স্বরে কুরআন তেলাওয়াত কর। কারণ সুন্দর আওয়াজ কুরআনের সৌন্দর্যকে বৃদ্ধি করে’। [দারেমী; মিশকাত হা/২২০৮; ছহীহাহ হা/৭৭১]
তবে এখানে সৌন্দর্যের অর্থ গভীর ভাবাবেগ এবং আল্লাহভীতি সহকারে সুন্দরভাবে তেলাওয়াত করা। যেমন রাসুল সা. অন্য হাদীছে বলেন,
‘সবচেয়ে সুন্দর আওয়াজে কুরআন তেলাওয়াতকারী ঐ ব্যক্তি, যার তেলাওয়াত শুনে তোমার মনে হবে যে, সে আল্লাহকে ভয় করছে’।  [ইবনু মাজাহ হা/১৩৩৯, সনদ ছহীহ]
(৭) আল্লাহ বান্দার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন একথা স্মরণ করা
নামাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটাই মূলত মহান প্রতিপালকের কাছে বান্দার একান্ত প্রার্থনা। তাই মুসল্লিকে সর্বদা মনে করতে হবে যে, আল্লাহ তার প্রতিটি প্রার্থনায় সাড়া দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে রাসুল সা.-এর নিম্নোক্ত হাদিসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি নামাজ কে আমার এবং আমার বান্দার মাঝে দু’ভাগে ভাগ করেছি। বান্দা আমার কাছে যা কামনা করবে তাই পাবে।
যখন আমার বান্দা বলে, (সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি সারা জাহানের মালিক)।
তখন আল্লাহ বলেন, (বান্দা আমার প্রশংসা করল)। যখন বলে, (পরম করুণাময় অসীম দয়াবান) আল্লাহ বলেন, (বান্দা আমার গুণগান করল)। যখন বলে, (বিচার দিবসের মালিক) আল্লাহ বলেন, (বান্দা আমার যথাযথ মর্যাদা দান করল)। যখন বলে, (আমরা কেবলমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং কেবলমাত্র আপনারই সাহায্য প্রার্থনা করি)। আল্লাহ বলেন, (এটি আমার ও আমার বান্দার মাঝে, আর আমার বান্দা যা চাইবে, তাই পাবে)। যখন বলে, (আপনি আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করুন। এমন ব্যক্তিদের পথ, যাদেরকে আপনি পুরস্কৃত করেছেন। তাদের পথ নয়, যারা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট হয়েছে)। আল্লাহ তাআলা বলেন, (এটা আমার বান্দার জন্য, আর আমার বান্দা যা প্রার্থনা করবে তাই পাবে)।  [মুসলিম হা/৩৯৫; মিশকাত হা/৮২৩]
রাসুল সা. অন্য হাদীছে বলেন, ‘তোমাদের কেউ নামাজে দাঁড়ালে সে মূলত তার প্রভুর সাথে কথোপকথন করে। তাই সে যেন দেখে, কিভাবে সে কথোপকথন করছে’।  [মুস্তাদরাক হাকেম; ছহিহুল জামে‘ হা/১৫৩৮]
উপরোক্ত হাদিস দু’টি স্মরণে থাকলে নামাজে একাগ্রতা বজায় রাখা সহজ হয়ে যায়।
(৮) সিজদার স্থানেই দৃষ্টি নিবন্ধ রাখা
নামাজে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য মুসল্লীকে দৃষ্টি অবনত রাখতে হবে এবং আশেপাশে দৃষ্টি দেওয়া যাবে না। রাসুল সা. নামাজের সময় মস্তক অবনত রাখতেন এবং দৃষ্টি রাখতেন মাটির দিকে। [বায়হাক্বী, হাকেম; আলবানী, ছিফাতু ছালাতিন নবী, পৃঃ ৬৯]
আর যখন তাশাহহুদের জন্য বসবে, তখন শাহাদত আঙ্গুলের প্রতি দৃষ্টি রাখবে। রাসুল সা. যখন তাশাহহুদের জন্য বসতেন, শাহাদত আঙ্গুলের মাধ্যমে কিবলার দিকে ইশারা করতেন এবং সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতেন। [ইবনে হিববান হা/১৯৪৭; ইবনে খুযায়মা হা/৭১৯, সনদ ছহীহ]
(৯) ভিন্ন ভিন্ন সূরা ও দো‘আ সমূহ পাঠ করা
নামাজে সবসময় একই সূরা ও একই দোআ না পড়ে, বিভিন্ন সূরা ও হাদিছে বর্ণিত বিভিন্ন দো‘আ পাঠ করলে, এর দ্বারা নতুন নতুন প্রার্থনা ও ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়। এজন্য মুসল্লীকে অধিক সংখ্যক দো‘আ এবং কুরআনের আয়াত মুখস্থ করা জরূরী।
(১০) আয়াতে তেলাওয়াতের সিজদা থাকলে সিজদা করা
সিজদায়ে তেলাওয়াত নামাজে একদিকে যেমন একাগ্রতা বৃদ্ধি করে, অন্যদিকে শয়তানকে দূরে সরিয়ে দেয়। আবু হুরায়রা রা. হ’তে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেন, বনূ আদম যখন তেলাওয়াত শেষে সিজদা করে, শয়তান তখন কাঁদতে কাঁদতে দূরে সরে যায়। আর বলে, আফসোস! আদম সন্তান সিজদার নির্দেশ পেয়ে সিজদা করেছে- তার জন্য জান্নাত। আর আমি সিজদার নির্দেশ পেয়ে অমান্য করেছি- আমার জন্য জাহান্নাম’। [মুসলিম হা/৮১; মিশকাত হা/৮৯৫]
(১১) শয়তান হ’তে আল্লাহর নিকট পানাহ চাওয়া
শয়তান মানুষের চিরশত্র“। যার প্রধান কাজই হ’ল ইবাদতে বান্দার একাগ্রতা নষ্ট করা এবং এতে সন্দেহ সৃষ্টি করা।
একদিন ওছমান বিন আবুল ‘আছ রা. রাসুল সা.-কে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! ‘শয়তান আমার এবং আমার নামাজ ও ক্বিরাআতের মাঝে প্রতিবন্ধকতা এবং নামাজে সন্দেহ সৃষ্টি করে। রাসুল সা. বললেন,  ‘এ শয়তানটিকে ‘খিনযাব’ বলা হয়। যখন তুমি এর প্ররোচনা বুঝতে পারবে, আল্লাহর কাছে পানাহ চাইবে এবং বাম দিকে তিনবার থুক মারবে। তিনি বলেন, আমি এমনটি করেছি, আল্লাহ তাআলা আমার থেকে শয়তানের ওয়াসওয়াসা দূর করে দিয়েছেন’। [মুসলিম হা/২২০৩; মিশকাত হা/৭৭]
রাসুল সা. বলেন, ‘তোমাদের কেউ নামাজে দাঁড়ালে শয়তান ভুলভ্রান্তি ও সন্দেহ সৃষ্টির জন্য নিকটবর্তী হয়, ফলে এক পর্যায়ে সে রাকআত সংখ্যা ভুলে যায়। কারো এমন হলে বসা অবস্থায় দু’টি সিজদা করে নিবে’। [বুখারি হা/১২৩২]
(১২) একাগ্রতার গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে জানা
রাসুল সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি নামাজের সময় হলে সুন্দরভাবে ওযূ করে এবং একাগ্রতার সাথে সুন্দরভাবে রুকূ-সিজদা করে নামাজ  আদায় করে, তার এ নামাজ  পূর্বের সকল গুনাহের কাফফারা হয়ে যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত না সে কোন কবিরা গুনাহে লিপ্ত হয়। আর এ সুযোগ তার সারা জীবনের জন্য’। [মুসলিম হা/২২৮; মিশকাত হা/২৮৬]
জানা আবশ্যক যে, একাগ্রতা ও খুকূর পরিমাণ অনুপাতে নামাজে ছওয়াব অর্জিত হয়। রাসুল সা. বলেন,
‘মুসল্লী নামাজ  আদায় করে, কেউ পায় দশভাগ নেকী, কেউ নয়ভাগ, আটভাগ, সাতভাগ, ছয়ভাগ, পাঁচভাগ, চারভাগ, তিনভাগ আবার কেউ অর্ধেক নেকী অর্জন করে’। [আহমাদ হা/১৮৯১৪; ছহীহুল জামে‘ হা/১৬২৬]
(১৩) নামাজের পরে বর্ণিত দো‘আসমূহ ও নফল নামাজ গুলি আদায় করা
নামাজ  পরবর্তী মাসনূন দো‘আ সমূহ পাঠ এবং সুন্নাতে রাতেবা সমূহ আদায় করলে নামাজের মধ্যে যে একাগ্রতা, বরকত ও  খুকূ অর্জিত হয়, পরর্তীতে তা বিদ্যমান থাকে। সেকারণ সম্পাদিত ইবাদতের কার্যকারিতা বজায় রাখার জন্য পরবর্তী ইবাদতগুলি অতীব গুরুত্ববহ। তাই নামাজের পরে মুসল্লী মাসনূন দো‘আগুলি পাঠ করবে। অতঃপর সারাদিনে মোট ১২ অথবা ১০ রাক‘আত সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাসহ বেশি বেশি নফল নামাজ  আদায় করার চেষ্টা করবে। কারণ নফল নামাজ  দ্বারা ফরযের ত্র“টি-বিচ্যুতি মোচন করা হয়। [আবুদাঊদ হা/৮৬৪; তিরমিজি হা/৪১৩; মিশকাত হা/১৩৩০, সনদ ছহীহ]
(১৪) বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা
অধিক কুরআন তেলাওয়াত হৃদয় জগতে সদাসর্বদা দ্বীনি চেতনা জাগরূক রাখে। সাথে সাথে মনের গভীরে এক ধরনের এলাহি প্রশান্তির আবহ সৃষ্টি করে। যা নামাজের একাগ্রতারজন্য একান্ত প্রয়োজন। তাই মুসল্লিীকে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াতে অভ্যস্ত হ’তে হবে।
উপরোক্ত আলোচনায় একাগ্রতা সৃষ্টির উপায় সমূহ স্পষ্ট করা হয়েছে। আশা করি উল্লিখিত বিষয়গুরো খেয়ালের সাথে মনের করে নামায আদায় করলে রাসূলের ঘোষিত নামাযের দশ ভাগের দশ ভাগ সওয়াবই আমরা পাব ইনশাআল্লা। আল্লাহ তাআলা আমাদের খুশুখুযুর সাথে নামায আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

Friday, September 27, 2013

নামাযের ব্যবহারিক গুরুত্ব

নামাযের ব্যবহারিক গুরুত্ব
 
প্রফেসর তহুর আহমদ হিলালী : একজন ব্যক্তির মুসলমান দাবিতে সে যে সত্যবাদী তার প্রমাণ হলো নামাযের জামাতে উপস্থিত হওয়া। রাসূল (সাঃ)-এর সময়ে কোন ব্যক্তি কয়েক দিন জামাতে অনুপস্থিত থাকলেই সাহাবারা (রাঃ) বলে বসতেন, সে মুনাফিক হয়ে গেছে। এই জন্য মুনাফিকরা মুসলমান হিসাবে পরিচয় দানের জন্য বাধ্য হয়ে জামাতে শরিক হতো। মুনাফিকদের সম্পর্কে সূরা আল মাউনে বলা হয়েছে, ‘তারা নামাযে অবহেলা করে, শৈথিল্য প্রদর্শন করে এবং লোক দেখানো কাজ করে'। রাসূল (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-এর যুগে নামায ত্যাগকারী লোকদের মুসলমান পরিচয় দানের কোন সুযোগ ছিল না। আল্লাহপাক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নামায নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ, কিন্তু কঠিন নয় তাদের জন্য যারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের ভয় রাখে'-সূরা আল বাকারা। তিনি আরো বলেন, ‘জাহান্নামীদের জিজ্ঞেস করা হবে, কোন জিনিস তোমাদেরকে জাহান্নামে নিয়ে এলো?-তারা বলবে, আমরা নামাযী লোকদের মধ্যে গণ্য ছিলাম না'- সূরা আল মুদ্দাস&&সর। এতে বোঝা যায়, নামায না পড়া অর্থ আখিরাতকে অবিশ্বাস এবং জাহান্নামে যাওয়ার উপযুক্ত হওয়া। হাদীসে স্পষ্ট বলা হয়েছে কাফির ও মুসলমানের মধ্যে পার্থক্যকারী বিষয় হলো নামায। হাদীসের ভাষ্য মতে নামায ত্যাগকারী ব্যক্তি মূলত মুসলমান নয় কাফের।
মুসলমান হওয়ার ক্ষেত্রে নামাযের গুরুত্ব আমরা উপলব্ধি করলাম। এত গুরুত্বের কারণ বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন নেই। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ)-এর জোরালো বক্তব্যই গুরুত্ব উপলব্ধির জন্য যথেষ্ট। তারপরও আমাদের আত্মপোলব্ধির জন্য নামাযের অসংখ্য ফায়দার মধ্যে ২/১টা নিয়ে আমরা আলোচনা করবো। আল্লাহপাক নামাযকে জামাতের সাথেই ফরজ করেছেন। ভাষাও ব্যবহার করেছেন বহুবচনের। তোমরা নামায আদায় কর বা রুকুকারীগণের সাথে রুকু কর। আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর আমলও ছিল তাই। তিনি মদীনায় হিজরত করে নিজের বাড়ীঘরের কথা চিন্তা না করে প্রথমেই একটি মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং সেই মসজিদে সাহাবায়ে কেরাম পাঁচ ওয়াক্ত নামায রাসূল (সাঃ)-এর ইমামতিতে আদায় করেন। সেই মসজিদে একজন অন্ধ ব্যক্তিকেও জামাতে না আসার সুযোগ দেয়া হয়নি। বরং জিজ্ঞাসা করা হয়েছে-তুমি কি আযান শুনতে পাও? তিনি বলেছেন-হ্যাঁ; তখন বলা হয়েছে তাহলে তোমাকে আসতে হবে। রহমাতুল্লিল আলামিন বলেছেন, ‘আযান শুনে যারা ঘরে বসে থাকবে আমার ইচ্ছা হয় তাদের ঘরগুলো আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিই-দিই না শুধু এ কারণে যে সেখানে নারী ও শিশু রয়েছে'। হযরত আলী (রাঃ) বলেন, ‘মসজিদের প্রতিবেশীদের নামায মসজিদেই আদায় করতে হবে'। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল-মসজিদের প্রতিবেশী কারা? তিনি জবাবে বলেছিলেন যারাই আযান শুনতে পায়। এ ছাড়া সাহাবায়ে কেরাম দুনিয়ার যেখানেই ছড়িয়ে পড়েছেন সেখানেই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। মসজিদ মূলত মুসলমানদের সমাবেশস্থল, তাদের কম্যুনিটি সেন্টার, শক্তিকেন্দ্র। আল্লাহপাক চান মুসলমানরা সংঘবদ্ধ জীবন-যাপন করুক। সংঘবদ্ধতা ছাড়া শয়তানের মোকাবেলায় টিকে থাকা বা তাকে আল্লাহর জমীনে প্রতিনিধি হিসাবে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা পালন সম্ভব নয়। আযান শোনার সাথে সাথে সকল মুসলমান ছুটে আসে আল্লাহর ঘর মসজিদে। না এসে উপায় কি? কি শক্তিশালী আহবান-আল্লাহু আকবর-আল্লাহ সর্বোচ্চ-সবার বড়-তাঁর আহবানের মোকাবেলায় তাঁর কোন দাসের আহবান কি মানা যায়? নামাযের দিকে এস, কল্যাণের দিকে এস। ঐ মুহূর্তে নামাযের চেয়ে কল্যাণকর আর কোন কাজ কি থাকতে পারে? মুসলমানরা মসজিদে উপস্থিত হয়ে এক ইমামের পেছনে কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। কাতার সোজা করা নামাযের একটি অন্যতম শর্ত। নামাজের এখানে বড় শিক্ষা হলো শৃক্মখলা ও আনুগত্য। মুক্তাদির দায়িত্ব হলো যথাযথভাবে ইমামকে অনুসরণ করা। মহল্লায় পাঁচজন যুবক সপ্তাহে একদিন একটি ক্লাবে উপস্থিত হলে মানুষ তাদেরকে সমীহ করে এবং বলে ওরা সংঘবদ্ধ, ওদের একজন লীডার আছে। অথচ আমরা দৈনিক পাঁচবার একত্র হই এবং লীডারের (ইমামের) আনুগত্যের মহড়া দিই। কিন্তু আমরা নিজেদের মধ্যে সেই শক্তিমত্তা অনুভব করি না। আমরা স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা পালন করি; এ থেকে কোন শিক্ষা নিই না। ইসলামের শিক্ষা হলো নামাযে যার আনুগত্য করা হবে সমাজেও তার আনুগত্য চলবে। আনুগত্যের এই প্রশিক্ষণ ছাড়াও সপ্তাহে একদিন ইমামের বক্তব্য শোনা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং ইমাম সাহেব তাঁর মুক্তাদিদেরকে ভালোর দিকে উদ্বুদ্ধ করবেন এবং তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে সমাজ থেকে অনাচার দূর করবেন। এটা আজ না ইমাম সাহেব উপলব্ধি করেন আর না মুক্তাদি। মানুষকে বক্তব্য শোনানোর জন্য হাজার হাজার টাকা খরচ করেও একত্রিত করা যায় না অথচ আল্লাহপাক কত চমৎকার একটি আযোজন করে দিলেন যেখানে মুক্তাদিদেরকে অত্যত্ম মনোযোগের সাথে ইমামের কথাগুলো শুনতে হয়। পাশে কেউ কথা বললে ভাই, চুপ কর-তাও বলা যায় না। কত ভক্তি-শ্রদ্ধা। শুধু পরিকল্পনা ও জ্ঞানের অভাবে এতবড় সুযোগ আজ মুসলমানরা কাজে লাগাতে পারছে না। ইমাম বা নেতার আনুগত্যের সীমাও আমরা নামাযের মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করতে পারি। ইমাম মানুষ, ভুল তাঁরও হতে পারে। সামান্যতেই অনাস্থা আনা কাম্য নয়। তাই শেখানো হয়েছে ইমাম সাহেব যদি সুন্নাত-মুস্তাহাব ভুল করে তা ধর্তব্যের বিষয় নয়, ওয়াজিব ভুল করলে সহু সিজদাহর মাধ্যমে ইমাম সাহেবকে শোধরায়ে নিতে হবে। কিন্তু ফরজ লংঘন করলে নামায পুনরায় আদায় করতে হবে। আমরা লক্ষ্য করি সুন্নাত-মুস্তাহাব নিয়ে আমাদের মধ্যে কত মত-পার্থক্য, দলাদলি, লড়াই-সংগ্রাম। অথচ নামাযের মত ইবাদত সুন্নাত-মুস্তাহাব ছাড়াই সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র দলাদলি ও মত-পার্থক্য পরিহার করে আজকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে। আল্লাহতা'লার আদালতে আমাদেরকে হারাম-হালাল ও ফরজ-ওয়াজিব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে। আমাদের ফরজ-ওয়াজিবে ঘাটতি থাকলে সুন্নাত-মুস্তাহাব পরিপূরক হিসাবে কাজে লাগবে এবং আমাদেরকে পূর্ণতায় পৌঁছে দিবে। হালাল-হারাম ও ফরজ-ওয়াজিব সম্পর্কে আমাদের মুসলিম সমাজে সচেতনতার মারাত্মক ঘাটতি। নামাযের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে সে সচেতনা আসতে পারে।
আল্লাহপাকের বাণী, ‘আমি জ্বীন ও মানুষকে কেবল আমারই গোলামী (ইবাদত) করার জন্য সৃষ্টি করেছি'। মানুষ আল্লাহপাকের সার্বক্ষণিক গোলাম-সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত এবং সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়-কোন একটি মুহূর্ত সে আল্লাহর গোলামীর বাইরে নয়। এ উপলব্ধি যাতে মানুষ ভুলে না যায় সেজন্যই মূলত পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ করা হয়েছে। একজন মুসলমানের ঘুম ভাঙে আযানের শব্দে এবং সে তখন আর মালিকের আহবানে স্থির থাকতে পারে না। আল্লাহর ঘরে ছুটে এসে প্রমাণ করে ‘প্রভু-পরোদিগার-আমি তোমারই গোলাম, আমি তোমার ঘরে হাজির'। নানা কর্মব্যস্ততার মধ্যে সকল কাজ পরিহার করে জোহর, আছর, মাগরিব এবং শোয়ার পূর্বে এশার জামাতে হাজিরা দিতে হয়। নামায বারবার আল্লাহর গোলামীর কথা স্মরণ করে দেয় বলে নামাযকে বলা হয় জ্বিক্র। নামাযের মাধ্যমে একজন নামাযী বারবার আল্লাহপাকের নিকট এই প্রতিশ্রুতিই প্রদান করে যে, ‘আমরা কেবল তোমারই গোলামী করি এবং তোমারই নিকট সাহায্য কামনা করি'। এই প্রতিশ্রুতি দান সত্ত্বেও মসজিদ থেকে বের হয়েই একজন নামাযী আল্লাহর নাফরমানি শুরু করে দেয়। আল্লাহর বাণী, ‘সালাত সমাপনান্তে তোমরা রুজির জন্য বেরিয়ে পড় এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর'। আল্লাহর স্মরণের জন্য যেমন নামায আদায় করা হলো ঠিক তেমনি কর্মক্ষেত্রে আল্লাহর বিধি-বিধান পালনের মাধ্যমে তাঁকে আরো বেশি বেশি স্মরণ করতে হবে। মানুষ যাতে সর্বক্ষণ আল্লাহর স্মরণ ও আল্লাহর ভয়ে আল্লাহর আদিষ্ট কাজ সম্পাদন এবং নিষিদ্ধ কাজ পরিহার করে চলতে পারে সে জন্যই মূলত নামায ও রোযার মত বিধান আমাদের প্রতি ফরজ করা হয়েছে। নামাযের জন্য নামায নয়, আবার রোযার জন্যও রোযা নয়। আল্লাহর নিষ্ঠাবান বান্দাহ হিসাবে গড়ে তোলার জন্যই এ সব আনুষ্ঠানিকতা। ইবাদতের মর্ম উপলব্ধি না করায় আজ মুসলমানরা স্রেফ নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত, তাছবীহ পাঠ ও নির্দিষ্ট মাপের পোশাক-পরিচ্ছদকেই কেবল ইবাদত মনে করছে এবং কর্মময় জীবনে আমাদের লেন-দেন, বিচার-আচার, অফিস-আদালত, চাল-চলন, আচার-ব্যবহার ইসলামসম্মত হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে মোটেই গুরুত্ব আরোপ করছে না। বরং মনে করছে কর্মময় জীবনে কিছু গুনাহ হলেও নামায-রোযার মাধ্যমে তা মাফ পেয়ে যাব। অথচ এসবই ভুল। বরং কুরআনের বক্তব্য ‘নামায নিঃসন্দেহে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখে'। নামায আদায়ের পরও যদি মানুষ পরিশুদ্ধ না হয় সে নামায মূলত মুনাফিকের নামায। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘যে নামায মানুষকে অন্যায় ও দুষ্কর্ম থেকে ক্ষান্ত করে না, সে নামায আল্লাহ ও মানুষের মধ্যে ব্যবধান বাড়িয়ে দেয়'। রোযা প্রসঙ্গেও একই কথা, ‘রোযা রেখেও যে মিথ্যা ছাড়তে পারলো না, সে রোযায় আল্লাহর কোনই প্রয়োজন নেই'। নামাযের মাধ্যমে আল্লাহকে দেয়া প্রতিশ্রুতি বারবার ভঙ্গ করে আমরা আল্লাহর নাফরমানিতে মেতে উঠেছি। অফিস-আদালতে ঘুষ, মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান, ওজনে কম, ভেজাল প্রদান, মিথ্যা কসম, ধোঁকা-প্রতারণা, মানুষের সম্মান হানি এমন কোন অপকর্ম নেই যা আজ মুসলিম নামধারীরা না করছে। এ সবই আল্লাহপাকের নাফরমানি, কবীরা গুনাহ এবং বন্দাহসুলভ আচরণের পরিপন্থি। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে সামাজিক জীবনে দুশমনি মূলত মুনাফিকদেরই কার্য। এ প্রসঙ্গে ইসলামের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) সাহাবীদেরকে (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমাদের মধ্যে দরিদ্র কে? সাহাবারা জবাব দিলেন যার টাকা-পয়সা নেই। তিনি বললেন, না- ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে দরিদ্র যে নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি সম্পাদন করার সাথে সাথে মানুষকে কষ্ট দেয়, তার হক নষ্ট করে-সেদিন যার প্রতি জুলুম করা হয়েছে তার পাওনা পরিশোধ করতে হবে তার অর্জিত ছাওয়াব দিয়ে এবং পূরণ না হলে মজলুমের গুনাহ তাকে দিয়ে অপমানের সাথে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে'। সমাজে যে সব কাজ নিন্দনীয় অর্থাৎ যা আমাদের সমাজটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে তার প্রত্যেকটি সম্পর্কে রাসূল (সাঃ)-এর উক্তি আমরা একটু স্মরণ করি। ঘুষের দাতা ও গ্রহীতা উভয়ই জাহান্নামী; এক দিরহাম সুদ খাওয়া ছত্রিশবার জ্বিনা অপেক্ষা জঘন্য; সকল নেশার দ্রব্য অবৈধ হারাম; গীবত জ্বিনা অপেক্ষা জঘন্য; মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া শিরকের সমতুল্য বড় গুনাহ; মিথ্যা সকল পাপের মা; যার ওয়াদা-প্রতিশ্রুতির ঠিক নেই তার ধর্ম নেই; যে আমানতের খেয়ানত করে তার ঈমান নেই। এভাবে যদি আমরা উল্লেখ করি তাহলে দেখবো মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ রকম সকল কাজই হারাম। নামায, রোযা আদায় না করা যেমন কবিরা গুনাহ; এ সব সামাজিক অপরাধ করাও কবিরা গুনাহ। আল্লাহর সাথে সংশ্লিষ্ট হুকুম লংঘন করলে আল্লাহর কাছে মাফ চাইলে পরিত্রাণ সম্ভব, কিন্তু বান্দাহর হক নষ্ট করলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিকট থেকেও ক্ষমা মঞ্জুর করে নিতে হবে। কাজটি বড়ই কঠিন। তাই নামাযে দেয়া প্রতিশ্রুতি আমাদের ব্যবহারিক জীবনে প্রতিপালনের মাধ্যমে আমরা আল্লহর প্রিয়ভাজন বান্দাহ হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারি। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফিক দান করুন। আমীন।

Saturday, September 21, 2013

ধৈর্য ও নামাজ যাবতীয় সঙ্কটের প্রতিকার

ধৈর্য ও নামাজ যাবতীয় সঙ্কটের প্রতিকার

বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।” (সূরা আল বাকারা, আয়াত ১৫৩)
বন্ধুরা, ভালো আছো আশা করি। আজ তোমাদের সামনে পবিত্র কুরআনের সবচেয়ে বড় সূরা সূরা আলা বাকারার একটি আয়াত নিয়ে আলোকপাত করছি।
ঈমানদারদেরকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের বিপদ-মুসিবত, আনন্দ-বিনোদন সর্বাবস্থায় ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। মানুষের দুঃখ-কষ্ট, যাবতীয় প্রয়োজন ও সমস্ত সঙ্কটের নিশ্চিত প্রতিকার এ দু’টি বিষয়ের মধ্যেই নিহিত। প্রথমটি সবর বা ধৈর্য। দ্বিতীয়টি নামাজ। সবর অর্থ হলো সংযম অবলম্বন ও নফসের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ। কুরআন-হাদিসের পরিভাষায় সবরের তিনটি শাখা রয়েছে। ১. আত্মাকে হারাম এবং না-জায়েজ বিষয় থেকে বিরত রাখা, ২. নিজেকে আল্লাহর ইবাদাত ও আনুগত্যে বাধ্য করা এবং ৩. যে কোনো বিপদ ও সঙ্কটে ধৈর্যধারণ করা। আমাদের পড়ালেখায়, পরীক্ষায়, ফলাফল লাভে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে, পরিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে সর্বক্ষেত্রে মানুষ যে সব অপ্রত্যাশিত বিষয়ের মুখোমুখি হয় তাকে মোকাবেলা করতে হয় ঠাণ্ডা মাথায় বুঝে শুনে। তবেই কেবল ফলাফলকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসা যায়। ধৈর্যের নিজস্ব কিছু সুন্দর ব্যাখ্যা আছেÑ ১. তাড়াহুড়া না করা। নিজের প্রচেষ্টার ত্বরিত ফল লাভের জন্য অস্থির না হওয়া এবং বিলম্ব দেখে হিম্মত হারিয়ে না বসা, ২. তিক্ত স্বভাব, দুর্বল মত ও সঙ্কল্পহীনতার রোগে আক্রান্ত না হওয়া, ৩. বাধা-বিপত্তির বীরোচিত মোকাবেলা করা এবং শান্ত চিত্তে লক্ষ্য অর্জনের পথে যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট বরদাশত করা, ৪.  সকল প্রকার ভয়ভীতি ও লোভ-লালসার মোকাবেলায় সঠিক পথে অবিচল থাকা।
মানুষের যাবতীয় সমস্যা ও সঙ্কট দূর করা এবং যাবতীয় প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পন্থাটি হচ্ছে নামাজ। রাসূল (সা)-এর পবিত্র অভ্যাস ছিল যে, যখনই তিনি কোনো কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতেন, তখনই নামাজ পড়তেন। আর আল্লাহতায়ালা সে নামাজের বরকতেই তাঁর যাবতীয় বিপদাপদ দূর করে দিতেন।
বন্ধুরা, আল্লাহ প্রত্যেক মানুষের জন্য দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন। তোমার ছোট ভাই-বোন থাকলে তাদেরকেও এখন থেকে নামাজ শিখতে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। রাতে আগে-ভাগে ঘুমিয়ে পড়ে ফজরে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে অভ্যাস গড়ে তোলো। সকল নামাজ গভীর মনোযোগ দিয়ে আন্তরিকতার সাথে আদায় করলে আল্লাহ আমাদেরকে সকল বিপদ-আপদ থেকে মুক্ত রাখবেন।
আল্লাহ আমাদেরকে বিপদে ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থন করার তাওফিক দিন। আমিন।
গ্রন্থনা : মিজানুর রহমান